ফেলের জনক জ্যাক মা – অনুপ্রেরণার গল্প
যারা স্বপ্ন দেখতে জানে তারা স্বপ্ন বুনতেও চিনে। আমরা স্বপ্ন দেখি
কিন্তু বুনতে গিয়েই খেতে হয় হুঁচটের উপর হুঁচট। প্রথমবারের হুঁচটে বিধস্ত হয়ে যায়
আমাদের মন। যখন এই হুঁচট বাববার হতে থাকে তখন সম্পূর্ণ মানষিকতায় বিগরে যায়। আর
কিছু করার মন মানষিকতা বাকি থাকে না। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছে যারা বার বার নয়
বহু বার শুধু অকৃতকার্যই হয়েছে। সফলতার মুখও তারা কখনই দেখেনি। দেখেনি সফলতার
উল্লাসিত মুহূর্ত। শুধু বুনেছে স্বপ্ন গড়ার অলৌকিক কিছু উত্তেজনা। আজ আমি আপনাকে
এমন একজনের সাথে পরিচিত করাতে যাচ্ছি যার কাছে বিফলতা মাথা নুয়িয়ে দিয়েছে। তার নাম
"জ্যাক মা"।
১৯৬৪ সালে গণচীনে জন্ম নেয়া এক অদম্য ব্যক্তি "জ্যাক মা"।
নিজ মাতৃভাষার সংক্ষিপ্ত গণ্ডী পেড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ছোট কালেই অদম্য এক
ফ্রিসার্ভিস প্রদান করেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য তিনি বাড়ি থেকে ৪০ মিনিটের
পথপাড়ি দিয়ে প্রতিদিন স্থানীয় হাংযু নামক হোটেলে যেতেন বিদেশি পর্যটকেদের সাথে কথা
বলার জন্য। ইংরেজি শিক্ষার উদ্বিগ্নতা তাকে বহুদূর নিয়ে গেছে। ইংরেজি কথোপকথন
শুনার জন্য রেডিওতে কান পেতে থাকতে। তরুণ জ্যাক মা ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার
উদ্দেশ্যে ঐ হোটেলে চাকরি নেন। এ এমনি একটি চাকরি যার কোন আর্থিক মূল্য নেই।
অর্থাৎ, বিনা পয়সায় তিনি পর্যটকদের পথ প্রদর্শন করাতেন। একটাই উদ্দেশ্য বিদেশীদের
সাথে কথোপকথন। সেখানে তিনি টানা ৯ বছর কাজ করেন। ছোট এক ছেলে পথ প্রদর্শন করাচ্ছে
কে না তার উপর মায়া না জন্মাবে। এর ফলে তার কিছু বিদেশি বন্ধুও জোটলো।
জীবনের শুরু থেকেই ব্যর্থতা তার পিছু নিয়েছে। প্রাথমিক স্কুল শুরুতেই
দুইবার অকৃতকার্য হন বালক জ্যাক। মাধ্যমিক শিক্ষায় তিনি তিনিবার ফেল করেন। কলেজ
জীবনের শুরুতে তিনি তিন বছর লাগিয়েছেন শুধু ভর্তির উপযুক্ত প্রমাণ করতে। গণিত
পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ছিলো ১। এর পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য
তিনি ১০ বার আবেদন করেন। কিন্তু এতেও তিনি অকৃতকার্য হোন। এতো ব্যর্থতার পর তিনি
স্থির করেন দেশীয় কোন কোম্পানিতে চাকরি করবেন। ছোট বড় মিলিয়ে তিনি প্রায় ৩০টি
কোম্পানিতে চাকরির আবেদন করেন। কিন্তু দেশেও তার নাজেহাল অবস্থা। কোন কোম্পানিতেই
তাকে চাকরি দেয়নি। তাতেও তিনি ক্ষান্ত হননি। শেষমেশ আর উপায় না দেখে চায়না ফাস্ট
ফুড রেস্টুরেন্ট "কেএফসি" তে চাকরির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তার
ভাগ্যটা এতই খারাপ যে, ২৪ জন পরীক্ষার্থী থেকে ২৩ জন উত্তীর্ণ হন একমাত্র জ্যাক মা
হয়ে যান অকৃতকার্য। এমন ভাগ্য যে মানুষ তাকে দেখে শুধুই হাসতো। এমনি আরো একটি
চাকরির আবেদনে ৫জন পরীক্ষার্থী থেকে ৪ জন কৃতকার্য করা হয়। শুধু বাদ পরে যায়
জ্যাক। এমনি বেহাল অবস্থা এই ব্যক্তির। এই দুটি ব্যর্থতা তাকে খুবি আক্রান্ত করে।
একটি অবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তৎকালীন ১২$ এর বিনিময়ে ইংরেজি
প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। এরপর তিনি রপ্তানিমুখী ব্যবসার জন্য ইংরেজি অনুবাদ
কেন্দ্র চালু করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম ইন্টারনেট নামের সাথে পরিচিত হন। ১৯৯৫
সালের প্রথম দিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে এক বন্ধুর সহযোগিতায়
ইন্টারনেটের প্রথম পাঠ নেন। সে সময় তিনি ইন্টারনেটে "বিয়ার" লিখে সার্চ
দিয়ে যে সমস্ত তথ্য পান, তার মধ্যে বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইটের অবদান থাকলেও নিজ দেশ
থেকে কোনো অবদান তার চোখে পড়েনি। এমনকি তার নিজের দেশের তথ্য ইন্টারনেটে সার্চ
দিয়েও না পেয়ে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হন জ্যাক। পরে এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি নিজদেশীয়
সাধারণ ওয়েবসাইট তৈরি করেন। ওয়েবসাইটটি প্রকাশ করার মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে
তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পান। এটিই মূলত তার ইন্টারনেট ভিত্তিক
ব্যবসা করার প্রথম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে তার জন্য।
১৯৯৫ সালে তার স্ত্রী জ্যাং ইং ও কিছু বন্ধু বান্ধবের সহযোগিতায়
প্রায় বিশ হাজার ইউএস ডলার সংগ্রহ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন বন্ধুর সহযোগিতায়
" নামের একটি কোম্পানি তৈরি করেন। তাদের মূলত কাজ ছিল চীনের বিভিন্ন
কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়া। ইন্টারনেট বিষয়ে কাজের উদ্দেশ্যে মাঠে
নামেন জ্যাক। সবচাইতে আশ্বর্যের বিষয় হল, তিনি ঐ সময় ওয়েব প্রোগ্রামিং বিষয়ে কিছুই
বুঝতেন না। মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেই কোম্পানি প্রায় আট লক্ষ ইউএস ডলারের মতো
মুনাফা লাভ করে। এই পরিমাণটা সেই সময়ের তুলনায় অনেক বিশাল ছিল। ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল
পর্যন্ত তিনি "চাইনা ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রনিক কমার্স সেন্টার" এর
প্রধান হয়ে কাজ করেন।
এর পরি পৃথিবীর যুগান্তরকারী ইকোমার্স সাইট আলীবাবা গ্রুপের আইডিয়া বাস্তবায়নের পথ উন্মোচন করেন।
আলীবাবা
গ্রুপ প্রতিস্থার জন্য তিনি তার ১৭ জন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ১জন ছাড়া
বাকি সবাই তার এই আইডিয়াকে "স্টুপিড আইডিয়া" আখ্যায়িত করেন। এতে তিনি
ভেঙে পরেননি বরং স্বনির্ভর হয়েই যাত্রা শুরুর চিন্তা করেন। পরিশেষে ১৯৯৯ সালে গড়ে
তোলেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান আলীবাবা ডট কম। চীন দেশের ভিতরে প্রথম প্রথম ব্যবসা
করলেও পরে আন্তর্জাতিক ভাবে রূপ দেন পদে পদে ব্যর্থ এই উদ্দ্যেগী। ১২$ দিয়ে প্রথম
কাজ শুরু করে আজ ৪৭.৮ বিলিয়ন ডলারের মালিক জ্যাক মা।
শিক্ষণীয়
উক্তিঃ
যখন আমার
বয়স ছিলো ১২ বছর। তখন আমি একবার পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিলাম এবং আমার প্রায় মরার
মত অবস্থা হয়ে গিয়েছিলাম কারণ, পুকুরের পানি এতই গভীর যে আমি যতটুকু গভীর চিন্তা
করি তার থেকেও গভীর।
তুমি যদি
চেষ্টাই না কর তবে তোমার জন্য সুযোগ আছে কিনা বুঝবে কি করে?
হাল ছেড়ে
দিও না। আজকে কঠিন দিন যাবে, আগামী কালের দিনটা খারাপ যাবে। কিন্তু আগামী কালের
পরের দিনটা তুমার জন্য উজ্জ্বল থাকবে।
শান্তির
বাণী সবসময় কঠিন ও জটিল হয়।
আমি মনে করি
তরুণরা তার আগের প্রজন্ম থেকে উন্নত হয়। আপনার এই কথাটি ভালো না লাগেও পারে। আমার
বাবা আমাকে বলেছিলো, "জ্যাক তুমি আমার মত হতে পারবে না। " কিন্তু আমি
তার থেকে উত্তম। আমার বাবা তার বাবার থেকে উত্তম ছিলো এবং আমার ছেলে মেয়েরা আমার
থেকে উত্তম হবে।
জীবনের প্রথম দিকে আমি শুধু মাত্র বেঁচে থাকার চেষ্টা করতাম। প্রথম
৩ বছরে আমাদের অ্যায় ছিলো শূণ্য। আমার এখনো মনে আছে, যতবার আমি রেস্টুরেন্টে গিয়ে
বিল প্রদান করতে চেয়েছি, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আমাকে বলতেন বিল পে করা হয়ে গেছে।
এবং বলতেন, " জনাব মা, আমি আলীবাবা প্রতিষ্ঠানের একজন ক্রেতা। সেখান থেকে আমি
অনেক টাকা আয় করেছি। আমি জানি এটা আপনি জানেননা তাই আমি বিলটা নিজেই পে করে দিয়েছি।
"
No comments