স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ আজ ।। মহাকাশ সম্ভাবনার দুয়ার খুলল
স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কক্ষপথে যাচ্ছে আজ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং কোনো কারিগরি জটিলতা না ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা এবং বাংলাদেশের স্থানীয় সময় মধ্যরাত ২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কক্ষপথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে। ফ্যালকন-৯ ব্লক ফাইভ নামের একটি রকেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চ প্যাড থেকে বাংলাদেশের এই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করা হবে।
মহাকাশে এই কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আরেকটি স্বপ্নের দুয়ার খুলছে বাংলাদেশের। প্রবেশ করতে যাচ্ছে স্যাটেলাইট যুগে। শুরু হতে যাচ্ছে নবযুগের নবসূচনা। বাংলাদেশের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। এই উৎক্ষেপণের মাধ্যমেই তথ্য-প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অর্জন বাংলাদেশকে আরো এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বলছে, খুব কম দেশেই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগেই আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো এত উন্নয়নের উদাহরণ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর উৎক্ষেপণ উদ্বোধন করবেন। ফ্লোরিডায় উৎক্ষেপণ কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবেন। আর ক্যাপ ক্যানাভেরালে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। বিটিআরসি বলেছে, দেশের প্রথম স্যাটেলাইটটির মধ্য দিয়ে টেলিমেডিসিন, ই-গবেষণা, ই-লার্নিং, ভিডিও কনফারেন্সসহ তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটবে। এতে করে প্রযুক্তি খাতে নতুন জগতে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে স্যাটেলাইটের বর্ধিত ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগও রয়েছে। বিটিআরসি বলেছে, আঞ্চলিক স্যাটেলাইট হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির আওতা থাকবে। এসব দেশের বেশির ভাগেরই নিজস্ব স্যাটেলাইট না থাকায় বাংলাদেশ তাদের কাছে এই সেবা বিক্রি করতে পারবে।
এ উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদসহ প্রায় ৪২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এছাড়া সাংবাদিকসহ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে সেখানে থাকবেন। তারা উৎক্ষেপণস্থল থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে প্রথম গ্যালারি থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করবেন। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে দ্বিতীয় গ্যালারিতে থাকতে পারবেন আরো প্রায় ২০০ জন। এরপর পাঁচ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি উন্মুক্ত স্থান থেকেও এ উৎক্ষেপণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যাবে।
উৎক্ষেপণ উপলক্ষে আজ উৎসবে মাতবে দেশ। ঐতিহাসিক এই দিন উদ্যাপনে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। এর মধ্যে রয়েছে উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান দেশের সব টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার, পরে সুবিধাজনক দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান উদ্যাপন, সন্ধ্যায় আতশবাজি প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রোড়পত্র ও ফটো অ্যালবাম প্রকাশ, স্মারক ডাকটিকিট উন্মুক্তকরণ এবং ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠান আয়োজন। বাংলাদেশ টেলিভিশন আজ বৃহস্পতিবার ওই রাত ২টা থেকে উৎক্ষেপণের ঐতিহাসিক মুহূর্ত সরাসরি সম্প্রচার করবে। দেশের সব জেলা-উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্ত সম্প্রচার করার ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি।
ফ্লোরিডার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে গত সোমবার বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানো একটি সাহসের বিষয়। এই সাহস দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে যাচ্ছি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তারই উত্তরসূরি হিসেবে মহাকাশে যাচ্ছে দেশের প্রথম যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও নিবিড় তদারকির মাধ্যমে এ বিষয়ে তার মেধা ও জ্ঞান কাজে লাগিয়েছেন।
বিটিআরসির তথ্যমতে, জ্বালানিসহ তিন হাজার ৭০০ কেজি ওজনের জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফ্যালকন-৯ কক্ষপথের দিকে ছুটবে কেনেডি স্পেস সেন্টারের ঐতিহাসিক লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯-এ থেকে। এই লঞ্চ কমপ্লেক্স থেকেই ১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে রওনা হয়েছিল অ্যাপোলো-১১। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের পর ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপরে কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে আট থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। এরপর স্যাটেলাইটটি দেশের গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযাগ স্থাপন করবে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর এটি কক্ষপথে সংযুক্ত হয়ে পূর্ণ কর্মক্ষম হতে কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগবে। আশা করা যায়, আগামী আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
এদিকে, স্যাটেলাইটটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাই কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এতে ১৮ জন প্রকৌশলীসহ ৩৫ জনের মতো জনবল রয়েছে। ভূমি থেকে উপগ্রহটি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নিজস্ব জমিতে দুটি ‘গ্রাউন্ড স্টেশন’ নির্মাণ শেষ হয়েছে।
এর আগে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রথমে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ ঠিক করা হলেও হারিকেন আরমায় ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় তা পিছিয়ে যায়। এরপর ৪ মে উৎক্ষেপণের সম্ভাব্য তারিখ রাখা হয়। পরে আরো দুদফা পিছিয়ে আজ ১০ মে উৎক্ষেপণের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় স্যাটেলাইট সিস্টেম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের থালেস এলিনিয়া স্পেসের সঙ্গে চুক্তি করে বিটিআরসি। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে অর্থায়নের জন্য এইচএসবিসি ব্যাংকের সঙ্গে গতবছর প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। এ স্যাটেলাইট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ ঋণ হিসেবে এইচএসবিসি ব্যাংক দিচ্ছে।
সরকারের আশা, বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ যে ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, এ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সেই অর্থ সাশ্রয় হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
No comments