তথ্যপ্রযুক্তি খাত সম্ভাবনার নতুন দুয়ারঃ কাওসার রহমান
আজকাল সব সেক্টরের উদ্যোক্তারাই নিজেদের
খাতে বিশাল সম্ভাবনা দেখেন। তারা মনে করেন, সরকারী সহায়তা পেলে তাদের খাতও
গার্মেন্টসে ছাড়িয়ে যাবে। যদিও দেশের গার্মেন্টস শিল্পের ধারে কাছে কোন খাত
নেই। যারা আছেন তারা অনেক পেছনে। আবার তাদের মধ্যে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠে
আসার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবে একটি খাতকে একটি ধাবমান গতিতে হলেও
উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে; সেটা হলো তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিং। বিশাল সম্ভাবনা
নিয়ে আউটসোর্সিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের
বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এখাতে আয় করছে ১০০ বিলিয়ন
ডলার। এখাতে বছরে আয় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে
ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিং পেশাজীবীরা আরও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। ফলে
বিশ্বের ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২২তম। ২০২১ সালে
আউটসোর্সিং থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। তাতে জিডিপিতে এ
খাতের অবদান দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। বর্তমানে এ খাতে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ যুক্ত
থাকলেও, ভবিষ্যতে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের বিশাল সম্ভাবনা দেখছেন
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা।
সরকারী তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সাত লাখ
তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী আছেন। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পেশাজীবী ছাড়াও দেশে
ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিংয়ে জড়িত আছেন প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। ২০১৮ সালের মধ্যে
দেশে ১০ লাখ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এতে সরকারের
চলমান উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন ও সামনের দিনগুলোতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এই
১০ লাখ পেশাজীবী তৈরি ও কর্মসংস্থান করা সম্ভব।
এই যে এত সম্ভাবনার কথা বলছি, অনেক সাধারণ
পাঠক হয়ত বলবেন আউটসোর্সিং আবার কী? আসলে আউটসোর্সিং হলো বাইরের মাধ্যম
থেকে কোন কাজ বা তথ্য নিজের কাছে নিয়ে আসা বা নিজের কাজ বা তথ্য অন্যের
কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তুলনামূলক কম মূল্যে করিয়ে নেয়া। শুধু ফ্রিলান্সিংকে
এককভাবে আউটসোর্সিং বলা চলে না। স্থানীয় বা নিজ দেশের কাজকেও আউটসোর্সিং
বলা যাবে না। আবার আউটসোর্সিং বলতে শুধু কল সেন্টার আউটসোর্সিং নয়।
টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, হোটেলের ব্যাক অফিসের কাজ, এইচআর,
আইটি, এ্যাকাউন্ট সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে
করার বিষয়টি সাধারণভাবে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা ‘বিপিও’ বলে পরিচিত।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আউটসোর্সিং যারা
করছেন তারা কারও মুখাপেক্ষী নয়। নিজেরাই কাজের সুযোগ তৈরি করে স্বাধীনভাবে
কাজ করছেন এবং আয় করছেন। এই আউটসোর্সিংয়ের কাজ যেমন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা
যায়, আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগেও করা যায়। বর্তমানে ৭ লাখ তরুণ তাদের নিজেদের
মতো করে ইন্টারনেটে ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে কাজ করছে। এরা কারও অধীনে নয়।
বরং নিজের অধীনে, নিজেই পছন্দ করে ঘরে বসে কাজ করছে। ফলে বাংলাদেশ এখন
বৈশ্বিক চাহিদায় আউটসোর্সিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছে। এ কারণেই আউটসোর্সিং
বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। এখাতে সম্ভাবনা দেখেই রাশিয়া
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসেছে। বাংলাদেশের আইটি খাতে ১০০ মিলিয়ন ডলার
বিনিয়োগ করবে রাশিয়া। দেশটির শীর্ষ আইটি প্রতিষ্ঠান ‘রাইট’ বাংলাদেশের আইটি
খাতে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন।
আউটসোর্সিংযের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুত ও
ব্রডব্যান্ড। এ দুটোই নিশ্চিত হয়েছে দেশে। ১০ বছর আগেও ইন্টারনেট খরচ ছিল ১
হাজার মার্কিন ডলার। আর এখন সেটা হাতের নাগালে। এজন্যই দেশের তরুণরা ঘরে
বসে আয় করতে পারছে। যেটা ১০ বছর আগে চিন্তাই করা যেত না।
গত ১৫ ও ১৬ এপ্রিল ঢাকায় দুই দিনব্যাপী
বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) সামিট অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এখানেই আমাদের
আউটসোর্সিংয়ের সম্ভাবনার কথাগুলো উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ আইসিটির
মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছে গেছে। যদিও এই
বিপ্লবের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা সঙ্কট রয়েছে। আমাদের
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আইসিটির জব মার্কেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
শিক্ষার্থীরা প্রোগ্রামিং জানে না। অথচ প্রোগ্রামিং জানা-শোনাদের চাকরি
খুঁজতে হয় না। প্রতিষ্ঠানই তাদের খুঁজে নেয়। তাই বাংলাদেশকে কৃষিনির্ভর দেশ
থেকে ক্রিয়েটিভ ইকোনমির দেশে পরিণত করতে হবে। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে
ডিজিটালে রূপান্তর করতে হবে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত
থাকতে হবে আইসিটি শিক্ষা।
এজন্য অবশ্য দেশে যে কাজ হচ্ছে না তা নয়।
আইসিটি জানা দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয় দেশের ১২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ আইসিটি ল্যাব করে দিয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই আইসিটি শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে
ভবিষ্যতে কম্পিউটার তরুণদের কাছে আর রহস্যময় থাকবে না। এক সময় আমাদের কাছে
কম্পিউটার ব্যবহার ভয়ের বিষয় ছিল। অনেকেই ই-মেইল পাঠাতেও জানতেন না। এখন আর
সেই অবস্থা আর নেই।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান ইন্ডাস্ট্রি
হচ্ছে এই বিপিও খাত। কিছু দিনের মধ্যে ৬০ শতাংশ চাকরি আউটসোর্সিং খাত থেকে
আসবে। আইসিটিতে বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনের গল্প, তার উল্লেখযোগ্য
অবদান হচ্ছে বিপিও খাতের। সরকার আইসিটি সেক্টর থেকে ২০২১ সাল নাগাদ যে ৫
বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, আশা করা হচ্ছে তার সিংহভাগ
অংশই আসবে এই বিপিও থেকে।
বিপিও খাতে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার
রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের এ বাজার ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এ বাজার বাংলাদেশের মতো
উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। এ জন্য
চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। এই বিপিও খাত শুধু নতুন নতুন কর্মসংস্থান
সৃষ্টিই নয়, দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও বড় অবদান রাখতে পারে। বিপিও খাতে
আমাদের আয়ের প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। এটি আরও বাড়ানোর সুযোগ
রয়েছে।
আইসিটিতে আয় করার জন্য উচ্চ শিক্ষিত হতে
হয় না। কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েই কাজ করা যায়। দেশের ৭০ শতাংশ তরুণের বয়স ৩৫
বছরের নিচে। এদের কাজে লাগাতে পারলেই আউটসোর্সিংয়ের সম্ভাবনা সত্যি হয়ে
দেখা দেবে।বর্তমানে লার্নিং আর্নিং কর্মসূচীর মাধ্যমে এসএসসি, এইচএসসি পাস ছেলে-মেয়েরাও তাদের গ্রামের বাড়িতে বসেই ডলার আয় করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৩৭ শতাংশ আসে মেধাস্বত্বাকে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশ কি সেটা পারে না। মেধাস্বত্তাকে কাজে লাগাতে হলে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিতে হবে। সেই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ আরও কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেট আরও দ্রুতগতির করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তিখাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের
বিকাশের জন্য ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে ‘বিপিও হাব’ গড়ে তোলার প্রস্তাবনা এসেছে
বিপিও সামিটের সেমিনার থেকে। এ বিষয়টির প্রতিও সরকারের নজর দেয়া উচিত।
পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগও
ত্বরান্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে
করেন তথ্যপ্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৫
বিলিয়ন ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখতে হলে সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেই
বিনিয়োগটা প্রত্যাশিত হতে হবে। পাশাপাশি এখাতে আয় বাড়াতে বিশ্ববাজারে
বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্রান্ডিং করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম
সুযোগ পেলেই নেতিবাচক প্রচারণা করছে। এটা বন্ধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের
মতো বাংলাদেশকেও ইতিবাচক প্রচারণা চালাতে হবে।
সর্বোপরি, আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকে যে
কল সেন্টার এবং ডাটা এন্ট্রি কাজের মধ্য দিয়ে বিপিওর ধারাটির সূচনা ঘটেছিল,
সময়ের পরিক্রমায় এখন এটি বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে এ ব্যাপারে নতুন
একটি জাগরণ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ‘বিপিও’ একটি নতুন সম্ভাবনার নাম। কারণ
বাংলাদেশের বিপিও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগের বেশি। বর্তমানে
বিশ্বজুড়ে বিপিওর বাজার ৫০০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দখল
করতে পেরেছে মাত্র ১৮০ মিলিয়ন ডলার! ফলে সহজেই অনুমেয়, বিপিও খাতে একটা
বিশাল বাজার পড়ে আছে। এখন যদি বাংলাদেশ এখাতে নজর দেয় তাহলে তৈরি
পোশাকশিল্পের পরই বিপিও হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত।
No comments