বঞ্চিত আজও বর্তমান শিশু
![]() |
প্রতিকী ছবি |
শিশুই আগামী দিনের নাগরিক-দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এ সত্যকে উপলব্ধি করেই শিশুর যথাযথ, নিরাপত্তা, সুরক্ষাসহ অন্যান্য অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর শিশু অধিকারের ঘোষণা অনুমোদন করে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাতৃগর্ভে শিশুর এক জীবন আছে। সেই জীবনের সুরক্ষার বিষয়টি শিশুর প্রথম অধিকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই
অধিকার কি আজ ও বাস্তবায়িত হয়েছে? শিশুরা আজ ও একটা দুঃসময় অতিক্রম করছে। অভাব-অনটন , ক্ষুধার জ্বালায় অবহেলিত শিশুরা আজ হয়ে উঠছে সন্ত্রাসী। ছিনতাই, রাহাজানিতে হিংস্র হয়ে উঠছে তাদের জীবন। শুধু দূর অতীত নয়, নিকট অতীতের দিকে তাকালেও আমাদের সামাজিক অধপতনের ভয়াবহতার হিসাব স্পষ্ট হয়ে যাবে। স্পষ্ট হয়ে যাবে পরিবর্তনের কারণটাও । উদাহরন স্বরুপঃ ২৬ নভেম্বর, ২০১৭ তে ভোপালে ১০ বছরের এক কন্যাকে গণধর্ষণের অভিযোগে ৬৭ বছরের এক বৃদ্ধা ও এক মহিলা-সমেত চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।গত বছরে ৩৫৮৯ টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনে শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৪৪১ শিশু অপমৃত্যুর শিকার এবং ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। তবে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় কিছুটা কমলেও বিএসএএফ মনে করে গত বছর গড়ে মাসে ২০টির অধিক শিশু হত্যা এবং ৩০টিরও বেশি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে করেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একটা সময় ছিল যখন মানুষ জিন, হিংস্র প্রাণী ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক ভয় পেত। তাই নির্জন পথে বা অন্ধকারে কোনো মানুষের উপস্থিতির আভাস পেলে নিরাপত্তাবোধ করতো, সাহস ও সান্ত্বনা পেত। কিন্তু এখন মানুষকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই এখন ভরদুপুরেও নির্জন পথে অপরিচিতি কাউকে দেখলে জানমাল হারাবার ভয়ে মানুষের বুক দুরুদুরু করে। আর সেই পরিস্থিতিতে শিশুরা কি করে স্বাধীন। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে ‘স্টেট অফ চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা করে শিশু অধিকার পরিস্থিতি এমন যে, পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৩৫৮৯টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনে শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৪৪১ শিশু অপমৃত্যুর শিকার এবং ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। গেল বছর ৬৪টি শিশু বাব-মায়ের নির্যাতনে নিহত হয়। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫টি শিশু বাবা মায়ের নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে। সেইসাথে স্কুলগামী কিশোরীদের প্রতি বখাটেদের অত্যাচার মারধর বেড়েছে। অপমৃত্যু হয়েছে ২৬৫টি শিশুর।হাঁ! এই প্রশ্ন আজ জাতির প্রতিটি সদস্যের, আহত সকল বিবেকের। কিন্তু এর উত্তর কী? আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করতে না পারলে এই অধঃপতন থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে কি? আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এসব ঘটনার পর সেমিনার, টকশো, গোলটেবিল আলোচনায় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, সামাজিক সচেতনতার অভাব, অসহিষ্ণু মানসিকতা ইত্যাদি গৎবাঁধা কিছু কথা বলে যান। রাজনৈতিক নেতারা একদল আরেক দলের উপর দোষ চাপান। সঠিক কারণ নিয়ে কেউ ভাবেন না। এই কারণের পেছনের কারণের দিকে কারো দৃষ্টি যায় না। ফলে উত্তরণের সঠিক পথে হাঁটার সুযোগ হয় না। তাই আমাদের সমাজিক অবক্ষয়ের কারণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তীব্রভাবে।জাতিসংঘ শিশু সনদের ২৮নং ধারায় সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ লক্ষ্যে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়নসহ ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু তা সত্যেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশই শিশু-শ্রমিক। কম মজুরি, মাত্রাতিরিক্ত খাটুনি ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে আমাদের দেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতি। শিশুরা এসব কাজে নিয়োজিত থেকে অনেক সময়ই কেবল জীবনধারণের খোরাকি পেয়ে থাকে, যা দয়া-দাক্ষিণ্য বলেও বিবেচিত হয়।দেশে শিশু অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র এখনো স্বাভাবিক হয়নি। নানা কারণে শিশুদের নিয়ে তাদের পরিবারের দিন কাটে আতঙ্কে। গত কয়েক বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিশুর প্রতি অপরাধ প্রবণতা কমে এলেও এখনো চলছে শিশু নির্যাতন। এখনো হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, বখাটেদের উৎপাত, পাচার, অস্বাভাবিক মৃতু্য, এসিড নিপেসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। ইউনিসেফের 'বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০০৬' অনুসারে, দেশে দেড় কোটির বেশি শিশু সুরার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ দেশের প্রায় ৭০ লাখ শিশু নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। ৫০ লাখ শিশু বস্তিতে বসবাস করছে। ৩০ লাখের বেশি শিশু শিৰা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বছরে বাংলাদেশের ১২ লাখ শিশু বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হচ্ছে। ১৪ লাখ শিশু শারীরিক প্রতিবন্ধী আর ১ হাজারেরও বেশি শিশু দেশের বিভিন্ন জেলে আটক রয়েছে। গত কয়েক বছরে শিশু হত্যার কয়েকটি লোমহর্ষক ঘটনা এ দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এরপর দ্রুত বিচার আইনের আওতায় শিশু হত্যার ঘটনায় আদালতের বেশ কয়েকটি রায়ে মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তাই জাতির কাছে প্রশ্ন, আজ ও কি শিশুরা তাদের সঠিক অধিকার পেয়েছে?
No comments